
১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর। কাকডাকা ভোর থেকেই সারাদেশের শহরে-বন্দর, গ্রাম-গঞ্জের পথে নেমে আসে হাজারো মানুষ। রেডিওতে ফের শোনা গেল শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের কণ্ঠস্বর: ‘আমি জিয়া বলছি।’ ফিরে এলো ২৬ মার্চের স্মৃতি। জনগণ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। বুকের ওপর থেকে সরে গেল জগদ্দল পাথর। পথে পথে শুরু হলো বিপ্লব ও বিজয় উল্লাসের মিছিল।
জনতার করতালিতে মুখরিত চারপাশ। বুকে বুকে মিলিত হলো সিপাহী ও জনতার আলিঙ্গন। কাঁধে কাঁধ, হাতে হাত, এক কণ্ঠে আওয়াজ: ‘সিপাহী-জনতা ভাই ভাই; জওয়ান জওয়ান ভাই ভাই; বাংলাদেশ জিন্দাবাদ; মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান জিন্দাবাদ; হাতের সঙ্গে হাত মেলাও—সিপাহী-জনতা এক হও।’ এত আনন্দ, এত উল্লাস—সিপাহী ও জনতার হৃদয়ের সঙ্গে হৃদয়ের কোরাস। এ এক অনবদ্য ইতিহাস।
আজ শুক্রবার সেই ঐতিহাসিক ৭ নভেম্বর। বাংলাদেশের ইতিহাসে মোড় ঘোরানো দিন। সিপাহী-জনতার বিপ্লবের দিন। এই বিপ্লবের মাধ্যমে চরম বিশৃঙ্খল ও অনিশ্চিত এক দুঃখজনক পরিস্থিতি থেকে ধীরে ধীরে নতুন পথে যাত্রা শুরু করেছিল বাংলাদেশ। ১৯৭৫ সালের এই দিনে দেশের সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমান ভূ-রাজনৈতিক, সম্প্রসারণবাদী ও নয়া উপনিবেশবাদী ষড়যন্ত্রের জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে এসেছিলেন। জাতির সংকটের মুহূর্তে দেশপ্রেমিক সিপাহী-জনতা চক্রান্তকারীদের সরিয়ে দিয়ে গণ-অভ্যুত্থান ঘটিয়ে তাকে দায়িত্বে বসিয়েছিল।
৭ নভেম্বরের পর শুরু হয় আত্মমর্যাদাশীল স্বকীয় ‘বাংলাদেশী সংস্কৃতির বিকাশ ও স্বাধীন বাংলাদেশী জাতিসত্তা’র নতুন যাত্রা। উদিত হয় নতুন আশার সূর্য। সেই সূর্যোদয়ের নায়ক ইতিহাসের বরপুত্র শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। নানা ষড়যন্ত্রের মধ্যেও তার স্মৃতি সাধারণ মানুষের অন্তরে অমর হয়ে থাকে।
১৯৭৫-এর ৭ নভেম্বরের ঘটনা প্রবাহের প্রত্যক্ষদর্শী, জিয়াউর রহমানের সহকর্মী ও এলডিপি চেয়ারম্যান কর্নেল (অব.) অলি আহমেদ, বীর বিক্রম বলেন, ‘১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ রাতে মেজর জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে আর্মি সর্বপ্রথম পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল। ওই রাতেই তিনি সবাইকে একত্রিত করে বললেন, এরপর আমরা সবাই মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ি। অন্যদিকে, শেখ মুজিব পাকিস্তানিদের কাছে আত্মসমর্পণ করলেন। যুদ্ধ চলাকালে তিনি দেশে ছিলেন না। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করলো দেশের সাধারণ জনতা। স্বাধীনতার পর তিনি লন্ডন হয়ে দিল্লি যান। এরপর দেশে ফিরে সশস্ত্র বাহিনীর ওপর ভরসা না রেখে রক্ষীবাহিনী গড়ে তোলেন। জনগণকে দমন করতে গঠন করেছিলেন মুজিব বাহিনী। ফলে ক্রমেই সেনাবাহিনীতে তার প্রতি ক্ষোভ তৈরি হতে থাকে।’
তিনি বলেন, ‘এই প্রেক্ষাপটে ১৫ আগস্ট একদল সেনা অফিসার তাকে হত্যা করে। হত্যার পিছনে অন্যতম কারণ ছিল, তিনি ওয়াদা থেকে সরে গিয়েছিলেন ও একদলীয় বাকশাল শাসন গড়ে তুলেছিলেন। তাকে হত্যা করা সেনা অফিসাররা তার ঘনিষ্ঠ সহচর খন্দকার মোশতাককে রাষ্ট্রপতি করে। এরপর ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ক্যু করেন। নিজেকে মেজর জেনারেল ঘোষণা করে সেনাপ্রধান হন। তবে সাধারণ সেনা সদস্যরা খালেদের অভ্যুত্থান মেনে নেননি। ফলে আরেকটি পল্টা ক্যু সংগঠিত হয়। সেই ক্যুতে জিয়াউর রহমানকে পুনরায় সেনা প্রধান হওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয় এবং তিনি দায়িত্ব গ্রহণ করেন।’
তিনি উল্লেখ করেন, ‘৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানটি আওয়ামী লীগের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য হয়েছিল। খালেদ মোশাররফ ৩ নভেম্বর ক্যু করেছিলেন, যা দেশের শৃঙ্খলাকে ভাঙে। সিপাহী-জনতার দ্বিতীয় অভ্যুত্থান দেশে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনে।’
সেনাবাহিনীতে জিয়াউর রহমানের জনপ্রিয়তা ছিল তুঙ্গে। অলি আহমেদ বলেন, ‘জিয়াউর রহমান ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। তিনি দেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি। জাতির দুর্দিনে তিনি দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন। সমগ্র জাতি আবার একত্রিত হলো। সেনাবাহিনীসহ সাধারণ মানুষের কাছে তিনি একজন জনপ্রিয় এবং সম্মুখসারির যোদ্ধা ছিলেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘জিয়াউর রহমান রাজনীতি করতে চাননি। সেনাবাহিনীকে পাঁচ ব্রিগেড থেকে পাঁচ ডিভিশনে উন্নীত করেছেন। দেশের কৃষি ও শিল্প বিপ্লব, খাল খনন এবং আইন-শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠায় তার অবদান ছিল বিশাল। সামরিক বাহিনীতে ফিরে আসা সম্ভব না হওয়ায় একমাত্র পথ ছিল সামনের দিকে এগোনো।’
৭ নভেম্বরের প্রত্যক্ষদর্শী বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ বলেন, ‘১৫ আগস্ট এবং ৩ নভেম্বরের ঘটনার পটভূমিতে ৭ নভেম্বর অবধারিত হয়ে পড়ে। সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ডকে বাইপাস করার কারণে সেনা দুটি অংশে বিভক্ত হয়ে যায়। একাংশ ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডে জড়িত, অপর অংশ চেইন অব কমান্ডের প্রতি অনুগত। কর্নেল আবু তাহের ও মেজর জলিল জাসদের নেতৃবৃন্দের নেতৃত্বে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা গঠন করে। ৭ নভেম্বর রাতের প্রথম প্রহরে তারা বিদ্রোহ করে জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করে সেনাবাহিনীর দায়িত্বভার পুনরায় গ্রহণ করান।’
মেজর হাফিজ বলেন, ‘জিয়াউর রহমান রাজনীতিতে যুক্ত হননি। কর্নেল তাহেরের প্রস্তাবে শহীদ মিনারে ভাষণ দেওয়ার সুযোগ ছিল, কিন্তু তিনি তা গ্রহণ করেননি। সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে কর্নেল তাহের ও তার সহযোগীদের গ্রেফতার এবং বিচারের মাধ্যমে শাস্তি দেন।’
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘৭ নভেম্বর সিপাহী-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জিয়াউর রহমান শক্ত হাতে হাল ধরেন এবং জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেন। বন্দীদশা থেকে মুক্তি রাষ্ট্রক্ষমতার চূড়ান্ত ধাপে পৌঁছে দেয়।’
ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘৭ নভেম্বর গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠায় তাৎপর্যপূর্ণ। এটি স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. মাহবুব উল্লাহ বলেন, ‘৭ নভেম্বর শহীদ জিয়ার মুক্তির মধ্য দিয়ে দেশের ওপর কালো ছায়া বিদূরিত হয়। তিনি রাষ্ট্রের কর্ণধার হয়ে ওঠেন। জাতি এই দিবসটি সৈনিক-জনতার ঐক্য ও সংহতির প্রতীক হিসেবে পালন করে।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, ৭ নভেম্বরের পটপরিবর্তনের পর প্রেসিডেন্ট জিয়ার নেতৃত্বে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব শক্তিশালী সত্তা হিসেবে রূপ লাভ করে। গণতন্ত্র অর্গলমুক্ত হয়ে অগ্রগতির পথে এগিয়ে যায়। মানুষের মনে স্বস্তি ফিরে আসে।
নিজস্ব প্রতিবেদক : 





















