
বাংলার প্রাচীন জলাভূমি চলনবিল আজ নতুন এক সংকটে বিপর্যস্ত। নৌকা, মাছ আর জলপথের প্রাণকেন্দ্র এই বিশাল বিল অঞ্চলে এখন দূষণের গন্ধে নষ্ট হচ্ছে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। তাড়াশ উপজেলার প্রায় পাঁচ হাজারেরও অধিক পুকুরে বাণিজ্যিক মাছ চাষের নামে নির্বিচারে ব্যবহার করা হচ্ছে মুরগির বিষ্ঠা, যা স্থানীয় ভাষায় লিটার নামে পরিচিত। ফলে প্রাকৃতিক পরিবেশ যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তেমনি মানুষের জীবনযাত্রাও হয়ে উঠেছে নানামুখী দুর্ভোগের সমার্থক।
কৃষি অধিদপ্তরের নিয়ম অনুযায়ী, মুরগির বিষ্ঠা যথাযথ প্রক্রিয়াজাত করে জৈব সার হিসেবে মাটিতে ব্যবহার করার কথা থাকলেও অধিকাংশ চাষি সে নিয়মকে অগ্রাহ্য করছেন। নিয়ম অনুসারে চার মাস মাটিতে পুঁতে রাখলে একশ কেজি বিষ্ঠা থেকে প্রায় পঞ্চাশ কেজি টিএসপির সমমানের জৈব সার পাওয়া সম্ভব। অথচ চলনবিল অঞ্চলে বিষ্ঠা সরাসরি খামার থেকে এনে পুকুরে ফেলা হচ্ছে। রাস্তার ধারে, পুকুরপাড়ে এবং জনবসতির কাছাকাছি যত্রতত্র বিষ্ঠার স্তূপে সৃষ্টি হচ্ছে মারাত্মক দুর্গন্ধ, দূষিত হচ্ছে পানি, এবং নষ্ট হচ্ছে পরিবেশের স্বাভাবিক ভারসাম্য।
সরেজমিনে দেখা যায়, মাছ চাষের আশায় স্থানীয় চাষিরা অজান্তেই জলাশয়ে মিশিয়ে দিচ্ছেন নানামুখী বিষাক্ততা। বিশেষ করে গ্রীষ্ম ও শীত মৌসুমে এ ব্যবহার আরও বেড়ে যায়। একের পর এক মৌসুমে একই পুকুরে পোল্ট্রি বিষ্ঠা মেশানোয় পানি হয়ে পড়ছে দুর্গন্ধময় ও অস্বাস্থ্যকর। এতে শুধু জলাশয়ের প্রাণীকুল নয়, আশপাশের মানুষও আক্রান্ত হচ্ছে পানিবাহিত নানা রোগে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, বিষ্ঠা ও পোল্ট্রি বর্জ্যের অপব্যবহারের কারণে চলনবিল অঞ্চলের অধিকাংশ পুকুরের পানি এখন আর ব্যবহারোপযোগী নেই। শিশুরা খেলার ছলে কিংবা অসচেতনভাবে এই পানিতে গোসল করতে নেমে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। মহিলারা গৃহস্থালির কাজে এ পানি ব্যবহার করায় জ্বর, চর্মরোগ, আমাশয়সহ নানান পানিবাহিত রোগ ছড়িয়ে পড়ছে গ্রামাঞ্চলে। অথচ দীর্ঘদিন ধরে এই অস্বাস্থ্যকর পরিস্থিতি চললেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে তেমন কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি।
রাস্তার পাশে জমে থাকা এই বিষ্ঠার স্তূপের কারণে পথচারীরা প্রতিনিয়ত দুর্গন্ধের মধ্যে চলাচল করছে। সাইকেল কিংবা মোটরসাইকেল চালাতে গিয়ে দুর্গন্ধে শ্বাস নেওয়াই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। অনেকে বাধ্য হয়ে বিকল্প পথ ব্যবহার করেন, আবার কেউ কেউ নাক চেপে পার হন। গ্রামীণ জীবনযাত্রার এই অসহনীয় বাস্তবতা প্রতিদিনই যেন নতুন করে দুর্ভোগের কাহিনি রচনা করছে।
এ প্রসঙ্গে তাড়াশ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) জিয়াউর রহমান (জিয়া) বলেন, “মুরগির বিষ্ঠার অপব্যবহার জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি। বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখা হচ্ছে। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে প্রশাসনের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেওয়া হবে।”
তবু প্রশ্ন থেকেই যায়, প্রশাসনের উদ্যোগ কি কেবল আশ্বাসেই সীমাবদ্ধ থাকবে, নাকি সত্যিই চলনবিলের আকাশ-বাতাস আবারো ফিরে পাবে তার নির্মল স্বরূপ? প্রকৃতি আজ যেন মানুষের অযাচিত লোভের কাছে বন্দি। চলনবিলের ইতিহাস, সংস্কৃতি আর জীববৈচিত্র্য রক্ষায় এখনই যদি সঠিক পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তবে বাংলার এই মহাবিল একদিন পরিণত হবে দূষণের ভারে নুইয়ে পড়া এক মৃত জলাভূমিতে।