
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের বিতর্কিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঘিরে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) ভূমিকা নিয়ে শুরু হওয়া তদন্ত। সাবেক তিন প্রধান নির্বাচন কমিশনার—হাবিবুল আউয়াল, একেএম নূরুল হুদা ও কাজী রকিবউদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ও অনৈতিক নির্বাচনী ব্যবস্থাপনার অভিযোগে সরকারিভাবে তদন্ত শুরু হয়েছে বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই তিনটি নির্বাচন দেশের গণতন্ত্র, ভোটাধিকার ও সাংবিধানিক শৃঙ্খলার ওপর সরাসরি আঘাত হেনেছে। বিপুল পরিমাণ জনগণের করের টাকায় পরিচালিত হয় এসব নির্বাচন; যেখানে রাতের অন্ধকারে ব্যালট ভর্তি, বিরোধী প্রার্থীদের ঠেকানো, প্রশাসনের অপব্যবহার ও দলীয় ক্যাডারদের সক্রিয় অংশগ্রহণ দেশজুড়ে তীব্র বিতর্কের জন্ম দেয়।
নতুন করে এই তদন্তের খবর ছড়িয়ে পড়তেই দেশের বিভিন্ন মহলে ব্যাপক ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। সচেতন নাগরিক সমাজ মনে করছে, এই পদক্ষেপ শুধু অতীতের অন্যায়ের বিচার নয়, বরং ভবিষ্যতের জন্য একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে—যাতে আর কোনো সরকার রাষ্ট্রীয় প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশনকে ব্যবহার করে প্রহসনের নির্বাচন করতে না পারে।
তবে শুধু সিইসি বা নির্বাচন কমিশনের সদস্যদের বিচারের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে সচেতন মহল দাবি তুলেছে—এই প্রহসনের নির্বাচনে মাঠ পর্যায়ে যারা বাস্তবায়ন করেছে, তাদেরকেও চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনতে হবে।
সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার একটি নজির সামনে এসেছে। স্থানীয় সূত্র ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্যে উঠে এসেছে, উল্লাপাড়ায় অনুষ্ঠিত তিনটি জাতীয় নির্বাচনে ভোট ডাকাতি, ভোটকেন্দ্র দখল, ভুয়া ব্যালট ভর্তি, প্রশাসনিক সহায়তায় রাতের ভোট ইত্যাদি ঘটনার পেছনে সরাসরি নেতৃত্ব দিয়েছেন স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি।
তালিকায় রয়েছেন সাবেক পৌর কাউন্সিলর আহসান আলী সরকার, জাহিদুজ্জামান কাকন, মীর আরিফুল ইসলাম উজ্জ্বল, হাফিজুর রহমান হাফিজ, চেয়ারম্যান সোহেল, রিভলি ইসলাম কবিতা, মনিরুজ্জামান পান্না, সাংবাদিক পরিচয়ে পরিচিত গোলাম মোস্তফা। এদের নেতৃত্বে স্থানীয় চেয়ারম্যান, ইউপি সদস্য, দলীয় ক্যাডার ও প্রশাসনের কিছু অংশ রাতের বেলায় ভোটকেন্দ্র নিয়ন্ত্রণ করেছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
উপজেলা পর্যায়ে তৎকালীন ইউএনও, ওসি ও কিছু জেলা প্রশাসক নির্বাচনের দিন দায়িত্ব পালন করেও এসব অনিয়মে কার্যত চোখ বন্ধ রেখেছেন কিংবা সরাসরি সহযোগিতা করেছেন বলে জানায় স্থানীয়রা। সচেতন মহল মনে করছে, তদন্তে এই পর্যায়ের কর্মকর্তাদেরও জবাবদিহির আওতায় আনলে কেবল প্রকৃত সত্য উন্মোচিত হবে।
উল্লাপাড়ার একজন সিনিয়র শিক্ষক বলেন, “এটা শুধু রাজনৈতিক দুর্নীতি নয়, এটা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ভোটাধিকার হরণ। এই সমস্ত অনিয়মের দায় কেবল ঢাকার কমিশনাররা নেবেন, আর যারা মাঠে ভোট চুরি করলেন তারা বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াবেন—এটা হতে পারে না।”
বাংলাদেশের গণতন্ত্রে দীর্ঘদিন ধরে নির্বাচনী প্রহসনের কালো ছায়া লেগে আছে। এবার যদি রাষ্ট্রযন্ত্র সঠিকভাবে তদন্ত করে প্রকৃত দোষীদের বিচারের মুখোমুখি করে, তাহলে তা হবে একটি যুগান্তকারী দৃষ্টান্ত। সেই সাথে সরকারের প্রতি অনুরোধ, শুধু সিইসি নয়—প্রান্তিক পর্যায়ের বাস্তবায়নকারীদেরও যেন বিচারের মুখোমুখি করা হয়।