
গ্রামের নাম জেলখানা। বরগুনা সদর উপজেলার এম বালিয়াতলী ইউনিয়নের সর্ববৃহৎ গ্রাম। বিশাল জনগোষ্ঠী এই গ্রামে বসবাস করলেও যুগ যুগ ধরে উন্নয়নের কোন ছোঁয়া লাগেনি এখানে। অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার হয়ে এই গ্রামের মানুষ প্রতিনিয়তই নানান সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন। অদ্যোবধি জেলখানার মানুষ দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হননি সরকারি-বেসরকারি সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর। মাত্র দেড় কিলোমিটার পাকা রাস্তা না থাকায় জন্য যুগের পর যুগ বরগুনা জেলা শহর থেকে বিচ্ছিন্ন রয়েছে জেলখানাবাসী। এম বালিয়াতলী ইউনিয়নের ১০ কিলোমিটার কাঁচা সড়কের ৫ কিলোমিটারই বেহালদশা। হাটু সমান কর্দমাক্ত কাঁচা সড়ক মাড়িয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেতে হয় ছাত্র ছাত্রীদের।
বছরের পর বছর সংস্কার না হওয়ায় গ্রামীণ কাঁচা সড়ক ডুবে থাকে পানিতে। জেলখানা গ্রামের কোন রাস্তায় কোন প্রকার যানবাহন চলাচলের উপযোগী নয়। প্রমতা পায়রা নদীর তীরে অবস্থিত জেলখানা গ্রামটিতে দুর্যোগকালীন সময় আশ্রয় নেয়ার মতো নেই কোন সাইক্লোন শেল্টার বা নিরাপদ উঁচু কোন ভবন। জেলখানা গ্রামের মোবাইল নেটওয়ার্ক না থাকায় শুধু বরগুনা নয়, সারা বিশ্ব থেকেই বিচ্ছিন্ন এই জনপদের মানুষ।
জেলখানা গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, আদিম যুগের তৈরি গ্রামীণ ভাঙ্গাচোরা কাঁচা সড়ক। ২০০৩ সালে ১ হাজার মিটার ইট বিছিয়ে সড়ক নির্মাণ হলেও আজ তা মরণ ফাঁদে পরিণত হয়েছে। স্বাভাবিক ভাবে হাটাও যেন দায়। খানাখন্দে ভরা ইট বিছানো সড়কে বৃষ্টির পানিতে জলকেলি করে হাঁসেরা। এম বালিয়াতলী ইউনিয়নের চৌমুহনী বাজার থেকে ডাকুয়াবাড়ী পর্যন্ত চালিতাবুনিয়া-বরগুনা সড়কে যেতে ইটের রাস্তা দিয়ে হেটে যাওয়া যেন দূর্গম পথ। গ্রাম বা ওয়ার্ড উন্নয়ন পরিকল্পনায় এই গ্রামের নাম থাকলেও কখনোই তা বাস্তবায়ন করে না স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিরা। জেলখানা গ্রামের বসবাসকারী সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান সেকেলেই রয়ে গেছে।অনেকেই মনে করেন বাংলাদেশের সবচেয়ে অনুন্নত গ্রামের মধ্যে অন্যতম গ্রাম বরগুনার জেলখানা গ্রাম। কারাগারের বন্দীদশায় আটক থাকার মতন সকল মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত জেলখানার গ্রামবাসী।
বর্ষাকালে জেলখানা গ্রামের মানুষের দুর্ভোগের অংক থাকে না। শহরে কিংবা স্থানীয় বাজারে যেতে হয় গামছা পড়ে। কোমলমতি শিশু, স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের পোশাকে লেগে থাকে কাদা আর বৃষ্টি ভেজা। অসুস্থ্ হলে চিকিৎসালয় নিতে হয় খাটে করে কিংবা বাঁশের সাথে চেয়ার বেঁধে ঝুলিয়ে।
যুগের পর যুগ ধরে উন্নয়ন বঞ্চিত থাকায় স্হানীয় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সোনালী স্বপ্ন যুব সংসদ ডাক দিয়েছে জনদুর্ভোগ থেকে মুক্তির গণদাবী। সোনালী স্বপ্ন যুব সংসদ শনিবার (২৭ সেপ্টেম্বর) সকাল ১০ টায় জেলখানা চৌমুহনী বাজারে পালন করে মানববন্ধন। সংগঠনের প্রতিষ্ঠাকালীন চেয়ারম্যান হাফেজ আল-আমীনের সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন এম বালিয়াতলী ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মনিরুজ্জামান, ইউনিয়ন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম আহবায়ক মোঃ সেলাইমান কবির ইউনুস, সদস্য সচিব আক্তারুল হক , জুয়েল মেলকার প্রমুখ। জেলখানা গ্রামের সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৩ দফা উত্থাপন করেন সোনালী স্বপ্ন যুব সংসদের সভাপতি মোঃ রাজীব।
মানববন্ধনে অবহেলিত মানুষের জনদুর্ভোগ মুক্তির গণদাবিতে জেলখানা গ্রামের সাধারণ মানুষ, স্কুল কলেজ মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা তাদের দাবী তুলে ধরে বক্তরা বলেন, দক্ষিণবঙ্গের একটি গ্রামের নাম জেলখানা ও চারাভাঙ্গা, ঝিনইবাড়িয়া। নাম শুনে মনে হতে পারে এখানে কোনো কারাগার আছে। কিন্তু আদতে তা নয়। তবুও গ্রামের মানুষের জীবন যেন প্রকৃত জেলখানার আসামীদের থেকেও কম কষ্টকর নয়। কোনো রাস্তাঘাট নেই, নেই যোগাযোগের ব্যবস্থা। কাঁচা রাস্তাও হয়নি। বিশ্ব যখন এআই যুগে প্রবেশ করেছে, তখনও এই গ্রামে মোবাইল ফোনে কথা বলা বা ইন্টারনেট ব্যবহার করা সম্ভব নয়। কথা বলতে চাইলে নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে দাঁড়াতে হয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাত্রছাত্রীরা স্বাভাবিকভাবে যেতে পারেনা। কাদায় হেটে আর বৃষ্টিতে ভেজা পোষাকে থেকে হয়ে পড়ে অসুস্থ্। গ্রামে নেই কোনো ক্লিনিক বা স্বাস্থ্যসেবা। নদীর ধারে গ্রাম হওয়ায় ঘূর্ণিঝড় বা বড় দুর্যোগে আশ্রয়ের জন্য নেই সাইক্লোন শেল্টার। হঠাৎ কেউ অসুস্থ হলে তাকে হাসপাতালে নেওয়ার মতো জরুরি কোনো ব্যবস্থা নেই। যোগাযোগ ও ব্যবস্থাপনার কারণে একাধিক মানুষের মৃত্যুও ঘটেছে। কৃষক থেকে সাধারণ মানুষ, সবাই ভোগান্তির শিকার।
বক্তারা অভিযোগ করে বলেন, মাঝে মাঝে সরকার বরাদ্দ দিলেও, তা জনগণের কাছে পৌঁছানোর আগেই কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তির পকেটে চলে যায়। ফলে বছরের পর বছর জেলখানার মতোই বন্দী জীবন কাটাচ্ছেন এখানকার মানুষ।