ঢাকা ০৯:০২ অপরাহ্ন, বুধবার, ১২ নভেম্বর ২০২৫, ২৮ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
News Title :
সিরাজগঞ্জে বিএনপি প্রার্থী ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুকে বিশাল গণসংবর্ধনা গাসিকের সাবেক কাউন্সিলর ও আ.লীগ নেতা মীর ওসমান গনি কাজল গ্রেফতার ভাঙ্গায় বিপুল পরিমাণ হাতবোমা ও পেট্রোল বোমাসহ তিন যুবক আটক নীলফামারীতে আরাফাত রহমান কোকো স্মৃতি ফুটবল টুর্নামেন্ট উদ্বোধন মান্দায় বিএনপির প্রার্থী ডা. টিপুর বিরুদ্ধে তীব্র বিক্ষোভ ও মানববন্ধন রংপুরে নারী সেনাসদস্য সেজে প্রতারণা, নাজমুল নামে এক যুবক আটক নাশকতার সন্দেহে অভিযান : সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুলের চট্টগ্রাম বাসভবনে পুলিশ, আটক ৭ ঈশ্বরদীতে গোল্ডেন এ প্লাস পাওয়া শিক্ষার্থীকে ল্যাপটপ প্রদান করলেন – হাবিবুর রহমান হাবিব গ্রামীণ টেলিকম ট্রাস্টের রিসোর্টে বোতল বোমা নিক্ষেপ ধামইরহাটে ইটভাটা বন্ধের প্রতিবাদে মালিক-শ্রমিকদের মানববন্ধন

হারিয়ে যাওয়া পেশা: ডাক পৌঁছানোর অবিচল পথিক – “রানার”

ঐতিহ্য আর ইতিহাসের পাতা থেকে: আজ থেকে কয়েকশো বছর আগে, যখন টেলিফোন, টেলিগ্রাম বা ডাকবাহক ট্রেনের নামও শোনেনি মানুষ—তখনই বাংলার যোগাযোগ ব্যবস্থার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষটি ছিলেন “রানার” বা “ডাক-রানার”। ঘামের বিনিময়ে খবর বহন করে এই মানুষগুলোই লিখেছিলেন প্রাচীন বাংলার যোগাযোগের ইতিহাস।

“রানার” পেশার আনুষ্ঠানিক সূচনা হয় ১৭শ শতকে মোগল আমলে। তবে ১৭৬৪ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যখন ডাক বিভাগ প্রতিষ্ঠা করে, তখন এটি সুসংগঠিত রূপ নেয়। ব্রিটিশদের প্রশাসনিক যোগাযোগ দ্রুত করার তাগিদেই ইউরোপীয় ডাক-সিস্টেমের আদলে পায়ে হেঁটে চলা রানারদের নিযুক্ত করা হয়। প্রথমে কলকাতা–ঢাকা–মুর্শিদাবাদ–চট্টগ্রামের মতো গুরুত্বপূর্ণ রুটে এটি চালু হলেও, দ্রুতই এই পেশাটি ঢাকা, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা ও রাজশাহী অঞ্চলে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

একজন রানার ছিলেন অবিচল ও বিশ্বস্ত। কাঁধে ডাকের থলে, হাতে একটি ঘণ্টা বা কখনো আত্মরক্ষার জন্য বর্শা নিয়ে তাঁরা মাইলের পর মাইল পথ অতিক্রম করতেন। রানারের আগমন বার্তা দিত তাঁর হাতের ঘণ্টার শব্দ। এই শব্দ শুনেই মানুষ বুঝতো – “ডাক আসছে!”

প্রতিটি রুটে নির্দিষ্ট দূরত্ব পরপর স্থাপিত হতো “রানার পোস্ট” বা “ডাক বাংলো”। সেখানে একজন রানার এসে তাঁর বহন করা চিঠি বা বার্তা পরবর্তী রানারের হাতে তুলে দিতেন। এভাবে দিন-রাত, ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে খবর পৌঁছে যেত।

তৎকালীন ঢাকায় নবাব, জমিদার ও সরকারি প্রশাসনের যোগাযোগ রক্ষার একমাত্র মাধ্যম ছিল এই রানাররা। তাঁদের উপরই নির্ভর করতো প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ চিঠিপত্র, যুদ্ধের বাণী, কিংবা বাণিজ্যিক বার্তা আদান-প্রদান। এই কারণে রানাররা ছিলেন বিশ্বাসের প্রতীক। গ্রামীণ বাংলায় “রানার এসেছে” – এই ডাক মানেই ছিল এক নতুন খবর, যা কখনো আনতো আনন্দের বার্তা, কখনো বা বেদনার সংবাদ।

অঞ্চলভেদে তাঁদের ডাকা হতো ডাক-বাহক, ডাক-পিয়ন, বা রানার-বালক নামে। তবে সব নামেই তাঁরা ছিলেন দায়িত্ব ও বিশ্বস্ততার মূর্ত প্রতীক।

রেললাইন, টেলিগ্রাফ, আধুনিক ডাক ব্যবস্থা এবং সর্বশেষ ডিজিটাল যোগাযোগের বিপ্লব এই পেশাটিকে আজ ইতিহাসের অংশে পরিণত করেছে। পেশা হিসেবে রানার আজ বিলীন। তবে বাংলাদেশের অনেক প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখনো কিছু গ্রামীণ ডাকবাহক সেই পুরোনো ঐতিহ্যের ধারক হিসেবে কাজ করছেন।

“রানার” ছিল শুধু একটি পেশা নয় – এটি ছিল বিশ্বাস, দায়িত্ব এবং দেশের প্রাণস্পন্দনের প্রতীক। তাঁদের ঘাম, ক্লান্তি আর দৃঢ় পদক্ষেপের ওপরই দাঁড়িয়েছিল বাংলার যোগাযোগের প্রাচীন ইতিহাস। এই অবিচল পথিকের দল চিরকাল বাংলার যোগাযোগ ঐতিহ্যে অমর হয়ে থাকবেন।

ট্যাগস :
আপলোডকারীর তথ্য

বার্তা বিভাগ

মিডিয়া তালিকাভুক্ত জাতীয় দৈনিক নববাণী পত্রিকার জন্য সকল জেলা উপজেলায় সংবাদ কর্মী আবশ্যকঃ- আগ্রহীরা আজই আবেদন করুন। মেইল: [email protected]
জনপ্রিয় সংবাদ

সিরাজগঞ্জে বিএনপি প্রার্থী ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুকে বিশাল গণসংবর্ধনা

হারিয়ে যাওয়া পেশা: ডাক পৌঁছানোর অবিচল পথিক – “রানার”

আপডেট সময় ০৯:১৭:২৯ অপরাহ্ন, রবিবার, ১২ অক্টোবর ২০২৫

ঐতিহ্য আর ইতিহাসের পাতা থেকে: আজ থেকে কয়েকশো বছর আগে, যখন টেলিফোন, টেলিগ্রাম বা ডাকবাহক ট্রেনের নামও শোনেনি মানুষ—তখনই বাংলার যোগাযোগ ব্যবস্থার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষটি ছিলেন “রানার” বা “ডাক-রানার”। ঘামের বিনিময়ে খবর বহন করে এই মানুষগুলোই লিখেছিলেন প্রাচীন বাংলার যোগাযোগের ইতিহাস।

“রানার” পেশার আনুষ্ঠানিক সূচনা হয় ১৭শ শতকে মোগল আমলে। তবে ১৭৬৪ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যখন ডাক বিভাগ প্রতিষ্ঠা করে, তখন এটি সুসংগঠিত রূপ নেয়। ব্রিটিশদের প্রশাসনিক যোগাযোগ দ্রুত করার তাগিদেই ইউরোপীয় ডাক-সিস্টেমের আদলে পায়ে হেঁটে চলা রানারদের নিযুক্ত করা হয়। প্রথমে কলকাতা–ঢাকা–মুর্শিদাবাদ–চট্টগ্রামের মতো গুরুত্বপূর্ণ রুটে এটি চালু হলেও, দ্রুতই এই পেশাটি ঢাকা, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা ও রাজশাহী অঞ্চলে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

একজন রানার ছিলেন অবিচল ও বিশ্বস্ত। কাঁধে ডাকের থলে, হাতে একটি ঘণ্টা বা কখনো আত্মরক্ষার জন্য বর্শা নিয়ে তাঁরা মাইলের পর মাইল পথ অতিক্রম করতেন। রানারের আগমন বার্তা দিত তাঁর হাতের ঘণ্টার শব্দ। এই শব্দ শুনেই মানুষ বুঝতো – “ডাক আসছে!”

প্রতিটি রুটে নির্দিষ্ট দূরত্ব পরপর স্থাপিত হতো “রানার পোস্ট” বা “ডাক বাংলো”। সেখানে একজন রানার এসে তাঁর বহন করা চিঠি বা বার্তা পরবর্তী রানারের হাতে তুলে দিতেন। এভাবে দিন-রাত, ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে খবর পৌঁছে যেত।

তৎকালীন ঢাকায় নবাব, জমিদার ও সরকারি প্রশাসনের যোগাযোগ রক্ষার একমাত্র মাধ্যম ছিল এই রানাররা। তাঁদের উপরই নির্ভর করতো প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ চিঠিপত্র, যুদ্ধের বাণী, কিংবা বাণিজ্যিক বার্তা আদান-প্রদান। এই কারণে রানাররা ছিলেন বিশ্বাসের প্রতীক। গ্রামীণ বাংলায় “রানার এসেছে” – এই ডাক মানেই ছিল এক নতুন খবর, যা কখনো আনতো আনন্দের বার্তা, কখনো বা বেদনার সংবাদ।

অঞ্চলভেদে তাঁদের ডাকা হতো ডাক-বাহক, ডাক-পিয়ন, বা রানার-বালক নামে। তবে সব নামেই তাঁরা ছিলেন দায়িত্ব ও বিশ্বস্ততার মূর্ত প্রতীক।

রেললাইন, টেলিগ্রাফ, আধুনিক ডাক ব্যবস্থা এবং সর্বশেষ ডিজিটাল যোগাযোগের বিপ্লব এই পেশাটিকে আজ ইতিহাসের অংশে পরিণত করেছে। পেশা হিসেবে রানার আজ বিলীন। তবে বাংলাদেশের অনেক প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখনো কিছু গ্রামীণ ডাকবাহক সেই পুরোনো ঐতিহ্যের ধারক হিসেবে কাজ করছেন।

“রানার” ছিল শুধু একটি পেশা নয় – এটি ছিল বিশ্বাস, দায়িত্ব এবং দেশের প্রাণস্পন্দনের প্রতীক। তাঁদের ঘাম, ক্লান্তি আর দৃঢ় পদক্ষেপের ওপরই দাঁড়িয়েছিল বাংলার যোগাযোগের প্রাচীন ইতিহাস। এই অবিচল পথিকের দল চিরকাল বাংলার যোগাযোগ ঐতিহ্যে অমর হয়ে থাকবেন।