
চলনবিলের বিশাল জলরাশিতে আর নেই আগের মতো থইথই পানি, নেই তেমন মাছের ছলছল শব্দ। শুকিয়ে যাওয়া বিলের বুকজুড়ে এখন নিস্তব্ধতা— আর সেই নিস্তব্ধতার ভেতরই শুঁটকি পল্লীর চাতালগুলোতে নেমেছে ছায়া নেমে আসা অচলাবস্থা। একসময় যে চাতালগুলো ছিল সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নারী-পুরুষের ব্যস্ততায় মুখর, আজ সেগুলো অনেকটাই ফাঁকা পড়ে আছে। মাছের অভাবে থেমে যাচ্ছে কর্মযজ্ঞ, বেকার হয়ে পড়ছেন শত শত দিনমজুর। বেকারত্বের আশঙ্কায় ভুগছেন অন্তত পাঁচ শতাধিক নারী ও পুরুষ শ্রমিক।
চলনবিলের ইতিহাসে এটি দেশের অন্যতম মিঠাপানির মাছের ভাণ্ডার। প্রায় ১২০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এ বিল ২২টি জলাশয় ও ১৬টি নদীর সমন্বয়ে গঠিত, যা বিস্তৃত হয়েছে সিরাজগঞ্জ, পাবনা ও নাটোর, এই তিন জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। সাড়ে চার হাজার হেক্টর জলাভূমিতে বছরের পর বছর ধরে আহরিত হয় অসংখ্য প্রজাতির দেশীয় মাছ। এই জলাভূমির একদিকে যেমন রয়েছে শস্যভাণ্ডারের সমৃদ্ধি, অন্যদিকে এখান থেকেই জোগান মেলে দেশের বড় একটি অংশের মিঠাপানির মাছের।
এই অঞ্চলের মানুষদের জীবিকা ঘুরপাক খায় মাছকে কেন্দ্র করে। বছরের নির্দিষ্ট সময়টাতে কর্মচাঞ্চল্যে মুখর হয়ে ওঠে এখানকার শুঁটকি পল্লীগুলো। সূর্য ওঠার আগেই নারী-পুরুষেরা ছুটে যান চাতালে। মাছ ধরা, লবণ মাখানো, শুকানোর মাচায় তোলা, বারবার উল্টেপাল্টে নাড়া, বাছাই, এভাবেই চলে তাদের দিনযাপন।
তাড়াশের মহিষলুটি থেকে চাটমোহর, সিংড়া, বোয়ালমারি, এমন অগণিত আড়ত থেকে প্রতিদিন শত শত মণ মাছ আসে এই চাতালগুলোতে। এখানকার মিঠা পানির শুঁটকি শুধু স্থানীয় বাজারেই নয়, পৌঁছে যায় রাজধানীসহ দেশের নানা প্রান্তে। সৈয়দপুর, নীলফামারী, ঢাকার খুচরা বাজার ছাড়িয়ে এই শুঁটকি এখন বিদেশেও সুপরিচিত পণ্য। ভারত, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, কাতার, ওমান, কুয়েত, ইরাক, লিবিয়া, ইন্দোনেশিয়া, এমনকি যুক্তরাষ্ট্র পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছে চলনবিলের হাতে বানানো শুঁটকি মাছ। একসময় বছরে প্রায় ৮০০ টন শুঁটকি উৎপাদিত হতো এই অঞ্চলে।
কিন্তু গত কয়েক বছরে চিত্রটি পাল্টে গেছে। বিলের পানি ক্রমে কমে যাওয়ায় মাছের প্রজনন ও টিকে থাকা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এতে একদিকে যেমন মাছের সংকট দেখা দিয়েছে, অন্যদিকে তার সরাসরি প্রভাব পড়েছে শুঁটকি শিল্পে।

তাড়াশ উপজেলার ঘরগ্রামের চাতাল মালিক আবু বক্কার জানান, “সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত মাছ সংগ্রহের মৌসুম। কিন্তু এবার আগের মতো মাছ ধরা যাচ্ছে না। প্রতিদিনের উৎপাদন নামছে ৫০–৬০ মণের নিচে। গত বছর যেখানে প্রায় ৮০০ টন শুঁটকি উৎপাদিত হয়েছিল, এবার সেখানে ১ হাজার টনের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও তা পূরণ হবে না।”
শ্রমিক ছকিনা বেগম, আল্পনা খাতুন ও রোমেছা বেগমের কণ্ঠে ঝরে পড়েছে হতাশা। তারা জানান, “আমরা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করি, দিনে ১৫০ টাকা মজুরি পাই। পুরুষরা পায় ৩০০ টাকা। কিন্তু মাছই যখন নেই, তখন কাজও নেই। শুঁটকি না হলে আমরা খাওয়াই বা কী?”
উল্লাপাড়ার চাতাল মালিক আলতাব হোসেন ও দেলবার হোসেনের মতে, চলনবিলে মাছের এই সংকটের পেছনে রয়েছে মানবসৃষ্ট কারণও। তারা বলেন, “বাদাই জাল দিয়ে পোনা মাছ ধরায় প্রজনন ধ্বংস হচ্ছে। অনেকে খরা মৌসুমে সেচ দিয়ে মাছ ধরে নিচ্ছে। ফলে বিলের মাছ ক্রমেই কমে যাচ্ছে। তাছাড়া বাজারে মাছের দাম বেড়ে যাওয়ায় শুঁটকি তৈরির খরচও অনেক বেড়েছে। গত বছর সৈয়দপুরের মহাজনদের সিন্ডিকেটে পড়ে আমাদের অনেকেই বড় লোকসানে পড়েছি, কারও ৫০ হাজার, কারও দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত ক্ষতি হয়েছে।”
মহিষলুটি মৎস্য আড়ৎদার তুষার মাহমুদ বলেন, “চলনবিলের মাছের সংকটে ইতিমধ্যেই অনেক চাতাল বন্ধ হয়ে গেছে। যেগুলো টিকে আছে, সেগুলিও বন্ধ হওয়ার পথে। প্রায় পাঁচ শতাধিক শ্রমিক বেকার হয়ে পড়ার আশঙ্কায় রয়েছে।”
চলনবিলের এই বাস্তবতা নিয়ে তাড়াশ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. মোকারম হোসেন জানান, “চলনবিলের শুঁটকি দেশের বাইরে পর্যন্ত জনপ্রিয়। কিন্তু মা মাছ নিধন, কৃষিক্ষেত্রে কীটনাশক ব্যবহার, এবং প্রাকৃতিক প্রজননক্ষেত্র সংরক্ষণে ব্যর্থতা, এসব কারণে মাছের পরিমাণ দিন দিন কমে যাচ্ছে। গত বছর এ উপজেলা থেকে ১৪৩ মেট্রিক টন শুঁটকি উৎপাদন হয়েছিল, কিন্তু এ বছর তা নেমে আসবে ১০০ থেকে ১১০ মেট্রিক টনের মধ্যে।”
চলনবিলের আকাশে তাই এখন কেবল কুয়াশা নয়, ভাসছে অনিশ্চয়তার ছায়া। যে বিল একসময় হাজারো মানুষের জীবিকার উৎস ছিল, আজ সেখানে ভর করেছে শঙ্কা, বিল শুকোলে যেমন মাছ মরে, তেমনি বিলের মানুষও হারায় তাদের রুজি।

এস. এম. রুহুল তাড়াশী স্টাফ রিপোর্টার: 



















