সবুজে ঘেরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের নৈসর্গিক লীলাভূমি পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটি। দুর্গম উঁচুনিচু পাহাড়ের অতি দুর্গম এলাকা রাঙ্গামাটি জেলার বিলাইছড়ি উপজেলার ফারুয়া ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ডের গবাইছড়ি পাড়ায় বসবাসকারী পিছিয়ে পড়া স্থানীয় শিশুদের মাঝে এখন ছড়িয়ে পড়েছে শিক্ষার আলো। যা এতোদিন কল্পনাও করেনি স্থানীয় জনসাধারণ। দুর্গম এই এলাকাটিতে ৬৫ টি পরিবারে ৩৭০ জন সদস্য বসবাস করছে যাদের মধ্যে ৬০ থেকে ৭০ জন শিশু রয়েছে। পাড়ায় কোন প্রাথমিক বা প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয় না থাকায় শিশুরা দীর্ঘদিন বঞ্চিত হচ্ছিলো শিক্ষা গ্রহনের মৌলিক অধিকার হতে।
এমতাবস্থায়, কমান্ডার, ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন বিগ্রেড কর্তৃক গবাইছড়ি পাড়ার সকলের মাঝে শিক্ষার আলোকে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য একটি বিদ্যালয় নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন বিগ্রেড এর দিকনির্দেশনায় এডহক ২৬ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্যাটালিয়নের নিরলস প্রচেষ্টায় গত ০২ ফেব্রয়ারী ২০২৫ তারিখ গবাইছড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয় এর নির্মাণ কাজ শুরু করা হয় এবং ০৪ মে ২০২৫ তারিখ কমান্ডার, ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন বিগ্রেড কর্তৃক “গবাইছড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয় উদ্ধোধন করা হয়। বর্তমানে এই বিদ্যালয়ের ১ম, ২য়, ৩য়, ৪র্থ ও ৫ম শ্রেণীতে মোট ৪৪ জন শিক্ষার্থী শিক্ষা গ্রহণ করছে। দুর্গম এলাকায় স্থাপিত নিজেদের স্কুল বারান্দায় দাঁড়িয়ে “আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি নিজ দেশের জাতীয় সংগীত মন খুলে গাইতে পারার আনন্দে ভাসছে স্কুলটির শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও পাড়ার স্থানীয় জনসাধারণ।
পাড়াটির গ্রাম্য প্রধান (কারবারি ) জানান, দেশ স্বাধীনের পূর্বে পূর্ব পাকিস্তান আমলে সরকারি ভাবে এলাকায় প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও ১৯৮০ সালে অভ্যন্তরীন স্থানীয় রাজনৈতিক সংগঠনের গ্রুপিংয়ের কারনে স্কুল সহ মানুষজনকে পার্শ্ববর্তী স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়। পরবর্তীতে পুনরায় ধীরে ধীরে মানুষজন এই এলাকায় বসবাস শুরু করে।
তিনি আরো বলেন, পূর্বে আমাদের এলাকার ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা অ-আ-ক-খ লিখতে পারতো না, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃক এই এলাকায় স্কুল নির্মাণ করায় বর্তমানে শিক্ষার্থীরা সহ আমরা আজ অনেক খুশি। যেখানে দারিদ্রতার মাঝে এই দুর্গম এলাকায় নিজেদের দৈনন্দিন মৌলিক চাহিদা পূরণে হিমশিম খেতে হয় সেখানে নিজেদের শিশুদের শিক্ষার উদ্দেশ্যে দীর্ঘপথ পায়ে হেটে নিকটবর্তী স্কুল শুক্কুরছড়ি অথবা ফারুয়া এলাকায় যাতায়াত করা সম্ভব হয়ে উঠে না। ফলশ্রুতিতে দীর্ঘদিন ধরে পাড়ার শিশুরা প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছিলো।
গবাইছড়ি দুর্গম পাহাড়ের শিড়ায় এবং পাহাড় ঘেষে রাইংক্ষণ খাল প্রবাহিত হওয়ায় এই এলাকাটি একটি বিচ্ছিন্ন জনপদে পরিনত হয়। পরবর্তীতে এডহক ২৬ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্যাটালিয়ন কর্তৃক গবাইছড়ি ব্রীজ নির্মাণ এর মাধ্যমে রাইংক্ষণ খাল এর দুইপ্রান্তে সংযোগ স্থাপন করা হয় এবং এই এলাকার সাথে পার্শ্ববর্তী এলাকার অবিচ্ছিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থা নিশ্চিত হয়।
স্থানীয় জনসাধারণের উষ্ণ অভ্যর্থনা শেষ না হতেই কানে ভেসে আসে “গবাইছড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয়” এর দপ্তরী স্কুলের ঘন্টা বাজিয়ে শিক্ষার্থীদের স্কুল মূখী হওয়ার আহবান জানাচ্ছেন। পাড়ার শিশুরা লাইন ধরে দাড়িয়ে কোমল কন্ঠে গাইছে জাতীয় সংগীত “আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি”এতে অংশগ্রহণ করেন স্থানীয় হেডম্যান কারবারি সহ অন্যান্য সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দ। প্রথম বারের মতো এই এলাকার শিশুরা নিজের দেশের জাতীয় সংগীত গাইছে দেশের লাল সবুজের জাতীয় পতাকা সামনে রেখে।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বলেন, এই এলাকার শিশুদের শুক্কুরছড়ি, ফারুয়া বা বিলাইছড়ি শহরে প্রতিনিয়ত যাতায়াত করে পড়ালেখা চলমান রাখা প্রায় অসম্ভব। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে অসংখ্য ধন্যবাদ দীর্ঘদিন পর এই পাড়ায় আমাদের অনেক প্রতিক্ষিত একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করে দেওয়ার জন্য।
শিক্ষার্থীদের একজন অভিভাবক বলেন, আমি অনেক দূরে গিয়ে প্রাথমিক শিক্ষা নিয়েছি, যাতায়াতের অসুবিধার কারনে পড়ালেখা শেষ করা সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃক গবাইছড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, ফলে আমাদের ছেলে-মেয়েরা এই স্কুলে লেখাপড়া করে জ্ঞান লাভের সুযোগ পাচ্ছে। আমরা সরকারের নিকট দাবী জানাচ্ছি যেন স্কুলটি দ্রুত জাতীয়করণ করা হয়। দীর্ঘদিন পর স্কুলে পড়ার সুযোগ পাওয়ায় খুশি সকল শ্রেনীর শিক্ষাথীরা।
দুর্গম এ এলাকায় বিদ্যালয় স্থাপনের বিষয়ে রাঙ্গামাটি জেলার সীমান্ত সড়ক প্রকল্প বাস্তবায়নকারী এই অঞ্চলের প্রকল্প কর্মকর্তা বলেন, গবাইছড়ি এলাকাটি খুবই দুর্গম হওয়ার কারনে এখানকার ছেলে মেয়েরা শিক্ষা গ্রহনের মৌলিক চাহিদা হতে দীর্ঘদিন বঞ্চিত ছিলো। পরবর্তীতে পাড়াবাসীর আবেদনের প্রেক্ষিতে ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডের সার্বিক পৃষ্ঠপোষকতায় এবং অধিনায়ক, ২৬ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্যাটালিয়ন এর দিকনির্দেশনা ও এই ইউনিটের সকল সদস্যের নিরলস প্রচেষ্টার ফলে “গবাইছড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয় “ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভবপর হয়।
তিনি বলেন, আমি আনন্দিত বাংলাদেশের পতাকা এখানে স্ব গৌরবে দাঁড়িয়ে আছে এবং কোমলমতি শিশুরা প্রতিদিন এখানে জাতীয় সংগীত গায়, এটি দেশপ্রেমিক বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্য হিসেবে আমাদের সবাইকে গর্বিত করে।
তিনি আরো বলেন, স্কুল পরিচালনার সমস্ত ব্যয়ভার বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃক বহন করা হচ্ছে এবং পরিচালনার সুবিধার্থে এই এলাকা ও পার্শ্ববর্তী এলাকা হতে তিনজন শিক্ষক, দুইজন শিক্ষিকা ও একজন দপ্তরী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যা তাদের কর্মসংস্থানেরও ব্যবস্থা করেছে।
শিক্ষার্থীদের বই ও প্রয়োজনীয় শিক্ষা সামগ্রী সরবরাহ করা হয়েছে এছাড়া স্কুলের শিক্ষকদের প্রতিমাসের মাসিক বেতন ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন বিগ্রেড কর্তৃক প্রদান করা হচ্ছে। এ এলাকার স্থানীয়রা জানান, সেনাবাহিনী তাদের অকল্পনীয় একটি আশা পূরণ করেছে।