চিকিৎসা মানুষের জীবনে অপরিহার্য হলেও আসল-নকল ডাক্তার চেনা এখন প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসায় ভুয়া ডাক্তারদের দৌরাত্ম্যে সাধারণ মানুষ পড়ছেন প্রতারণার ফাঁদে। বড় বড় সাইনবোর্ডে নামের পাশে জটিল সব ডিগ্রি আর পদবী দেখে রোগীরা চিকিৎসার জন্য ছুটে গেলেও অনেকেই আসলে অবৈধভাবে চিকিৎসা দিয়ে আসছেন বছরের পর বছর।
সম্প্রতি গাজীপুরে অনুসন্ধানে উঠে আসে উদ্বেগজনক সব তথ্য। জানা যায়, হোমিওপ্যাথিক সার্টিফিকেট, হোমিওপ্যাথিক বোর্ড রেজিস্টেশন, স্বাস্থ্য সনদ ও ড্রাগ লাইসেন্সবিহীন বহু হোমিওপ্যাথিক চেম্বার পরিচালিত হচ্ছে।
প্রাক্তন প্রভাষক জুলফিকার হায়দার নিজেকে বি.এ.ডি.এইচ.এম.এস ও “হ্যানীমন স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত চিকিৎসক” হিসেবে পরিচয় দিলেও বাংলাদেশে এমন কোনো কোর্স নেই। প্রকৃতপক্ষে তিনি ডিএইচএমএস পাস করেছেন এবং সাধারণ অনার্স ডিগ্রিকে চিকিৎসাবিদ্যার সঙ্গে জুড়ে ব্যবহার করছেন। তার হোমিওপ্যাথিক বোর্ড রেজিস্ট্রেশনের মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০০৩ সালে। অথচ টানা ২৩ বছর ধরে তিনি রোগী দেখছেন এবং প্রতিটি সাক্ষাতে নিচ্ছেন ৩০০ টাকা ভিজিট, জীবন হোমিও হল নামে একটি চেম্বার রয়েছে গাজীপুর মালেকের বাড়িতে।
এছাড়া গাজীপুর হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজের বর্তমান শিক্ষার্থী নুরুন্নবী সরকার, যিনি চেম্বার পরিচালনা করে আসছে গাজীপুর চৌরাস্তা শাহআলম বাড়িতে। চিকিৎসা বিদ্যার কোন সার্টিফিকেট বা রেজিস্টেশন তিনি দেখাতে পারেননি। অথচ সাইনবোর্ডে একটি গভঃরেজিঃ নামে একটি ভুয়া রেজিস্টেশন ব্যবহার করেছেন এবং বিভিন্ন পদ পদবী ব্যবহার করেছেন।
একই কলেজের লাভলী রহমান ও রুবেল নামের কয়েকজন নিজেদের নামের পাশে ডাক্তার লিখে চেম্বার চালাচ্ছেন। তাদের দাবি, কলেজ থেকেই নাকি অনুমোদন দেওয়া হয়েছে চেম্বার বসানোর। লাভলী রহমান জানান ৪র্থ বর্ষে ওঠলেই ডা. পদবী ব্যবহার করা যায়। তাদের সাহস বাড়ানোর জন্য কলেজ থেকে চেম্বার করার আদেশ দেয়া হয়েছে। আমেনা হোমিও হল, নিরাময় হোমিও হল, জার্মান হোমিও হল, সিয়াম হোমিও হল সহ আরও অনেক হোমিও চিকিৎসালয় রয়েছে যারা হোমিওপ্যাথিক বোর্ডের রেজিস্টেশন, ড্রাগ লাইসেন্স, স্বাস্থ্য সনদ ছাড়াই চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছে।
অনুসন্ধানে আরও উঠে আসে ওই কলেজের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মানিক মিয়ার দুর্নীতির তথ্য। তার কাছে অতিরিক্ত টাকা দিলেই মেলে সার্টিফিকেট ও রেজিস্ট্রেশন। একজন শিক্ষার্থীর ছদ্মবেশে তার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথিক বোর্ড থেকে রেজিস্ট্রেশন আনতে ছয় হাজার পাঁচশত টাকা লাগে। যেখানে সরকারি খরচ মাত্র দুই হাজার টাকা। এ কাজে তার সহযোগী হিসেবে রয়েছেন কলেজের আরেক কর্মচারী মুকল শিকদার।
বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথিক আইন ২০২৩ অনুযায়ী, কেবল ডিএইচএমএস বা বিএইচএমএস ডিগ্রিধারী এবং বোর্ড কর্তৃক রেজিস্ট্রেশনপ্রাপ্ত চিকিৎসকই নামের পাশে ডাক্তার লিখতে পারবেন। অন্যথায় আইন ভঙ্গকারীর বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ এক লক্ষ টাকা জরিমানা ও এক বছরের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।
গাজীপুর সিভিল সার্জন ডা. মামুনুর রহমান বলেন, 'এই বিষয়ে আমরা অবগত হয়েছি, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমরা বিভিন্ন স্থানে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে আসছি, এমন সংবাদ পাওয়ার সাথে সাথে আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করব।'
চিকিৎসা মানুষের জীবনের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। তাই গাজীপুরে ভুয়া হোমিওপ্যাথিক ডাক্তারদের দৌরাত্ম্য শুধু প্রতারণাই নয়, এটি জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় হুমকি। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কঠোর নজরদারি ও আইনগত ব্যবস্থা এখন সময়ের দাবি।