
আধুনিক বিশ্বের গতিময় ছন্দে যখন তথ্যপ্রযুক্তির ঢেউ গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ছে, তখনও স্থানীয় সংবাদ পরিবেশনার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে টিকে আছেন মফস্বল সম্পাদকরা। তারা কেবল একটি সংবাদপত্রের প্রধান নন, বরং নিজেদের এলাকা, মানুষ এবং তাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার প্রতিচ্ছবি। নীরব কর্মী হয়ে তারা নিরলসভাবে কাজ করে চলেছেন, যেখানে প্রতিটি খবর শুধু তথ্য নয়, বরং একটি এলাকার স্পন্দন।
মফস্বল সম্পাদকদের কাজ শহরের সুসজ্জিত সংবাদ কক্ষের চেয়ে একেবারেই আলাদা। সীমিত সম্পদ, অপ্রতুল জনবল এবং প্রায়শই প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও তাদের বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনের দায়ভার পালন করতে হয়। গ্রাম বা ছোট শহরের প্রতিটি আনাচ-কানাচের খবর, স্থানীয় সমস্যা, সাফল্যের গল্প—সবকিছুই তাদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ধরা পড়ে। রাস্তাঘাটের বেহাল দশা থেকে শুরু করে কৃষকের ফসলের সংকট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সমস্যা থেকে শুরু করে গ্রামীণ উৎসবের চিত্র—সবকিছুই তাদের লেখনীতে জীবন্ত হয়ে ওঠে। তারা স্থানীয় প্রশাসন ও সাধারণ মানুষের মধ্যে একটি যোগসূত্র স্থাপন করেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে সাহসী কণ্ঠস্বর তোলেন এবং উন্নয়নের প্রতিটি পদক্ষেপে জনমত গঠনে সহায়তা করেন।
সাংবাদিকদের বিকাশে মফস্বল সম্পাদকদের অনন্য ভূমিকা
মফস্বল সম্পাদকরা শুধু নিজেদের সংবাদপত্রের ধারক নন, তারা নবীন এবং স্থানীয় পর্যায়ের সাংবাদিকদের জন্য এক অনবদ্য আশ্রয়স্থল ও পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করেন। তাদের এই সহায়ক ভূমিকা বহুস্তরী:
* পরামর্শ ও প্রশিক্ষণ: বহু নবীন সাংবাদিক, বিশেষ করে যারা এই পেশায় নতুন, তাদের হাতেখড়ি হয় মফস্বল সম্পাদকদের কাছে। সংবাদ সংগ্রহ, লেখালেখির কৌশল, শিরোনামের গুরুত্ব বা সংবাদ প্রকাশের নৈতিক দিক—এসব বিষয়ে সম্পাদকরা তাদের অমূল্য অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান দিয়ে সাংবাদিকদের দক্ষ করে তোলেন। তারা একই সাথে একজন শিক্ষক এবং পরামর্শদাতার ভূমিকা পালন করেন, যা স্থানীয় সাংবাদিকতার মানোন্নয়নে অপরিহার্য।
* দিকনির্দেশনা ও অনুপ্রেরণা: একজন মফস্বল সম্পাদক তার অঞ্চলের সমস্যা ও সম্ভাবনা সম্পর্কে গভীরভাবে অবগত থাকেন। তারা সাংবাদিকদের এমন সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোকপাত করেন, যা হয়তো তাদের চোখ এড়িয়ে যেতে পারে। কোন ঘটনাকে কতটা গুরুত্ব দিতে হবে, বা কোন বিষয়ে গভীর অনুসন্ধান প্রয়োজন, সে সম্পর্কে তারা সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দেন। তাদের এই দিকনির্দেশনা ও অনুপ্রেরণা অনেক সময় প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও সাংবাদিকদের নির্ভয়ে কাজ চালিয়ে যেতে সাহস যোগায়।
* নিরাপত্তা ও সমর্থন: মফস্বল পর্যায়ে সাংবাদিকদের কাজ করা প্রায়শই ঝুঁকিপূর্ণ। স্থানীয় ক্ষমতাশালী ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর অসন্তোষের মুখে পড়ার আশঙ্কা থাকে। এমন পরিস্থিতিতে মফস্বল সম্পাদকরা নিজেদের সাংবাদিকদের পাশে ঢাল হয়ে দাঁড়ান। তারা প্রয়োজনীয় আইনি সহায়তা থেকে শুরু করে মানসিক সমর্থন পর্যন্ত সবকিছু দেন। সম্পাদকদের এই মজবুত সমর্থন সাংবাদিকদের স্বাধীনভাবে কাজ করার আত্মবিশ্বাস জোগায়।
* যোগাযোগের সেতুবন্ধন: সম্পাদকরা স্থানীয় প্রশাসন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, জনপ্রতিনিধি এবং বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক বজায় রাখেন। এই বিস্তৃত যোগাযোগ সাংবাদিকদের জন্য খবরের তথ্য সংগ্রহে এবং সঠিক ব্যক্তির সাথে যোগাযোগ স্থাপনে অত্যন্ত সহায়ক হয়। অনেক সময় সম্পাদক নিজেই সাংবাদিকদের জন্য প্রাথমিক যোগাযোগের পথ সুগম করে দেন।
* পেশাগত মান রক্ষা: একজন অভিজ্ঞ মফস্বল সম্পাদক তার অধীনস্থ সাংবাদিকদের দিয়ে পেশাদারিত্ব এবং নৈতিকতার সর্বোচ্চ মান বজায় রেখে কাজ করান। তারা নিশ্চিত করেন যেন কোনো ভুল তথ্য বা গুজব প্রকাশিত না হয় এবং সাংবাদিকরা নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠভাবে সংবাদ পরিবেশন করেন। এটি স্থানীয় সাংবাদিকতার বিশ্বাসযোগ্যতা এবং সুনাম অক্ষুণ্ণ রাখতে অত্যাবশ্যক।
মফস্বল সম্পাদকদের প্রায়শই ব্যক্তিগত ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হয়। স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর অসন্তোষের শিকার হওয়ার ভয়, আর্থিক সীমাবদ্ধতা, আধুনিক প্রযুক্তির অভাব এবং পর্যাপ্ত লোকবলের সংকট—এগুলো তাদের নিত্যদিনের চ্যালেঞ্জ। তবুও তারা নিরন্তর কাজ করে যান, কারণ তারা জানেন তাদের লেখনীর মাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিটি শব্দের গুরুত্ব কতখানি।
দুঃখজনক হলেও সত্য যে, মফস্বল সম্পাদকদের এই আত্মত্যাগ এবং অবদানকে অনেক সময় যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা হয় না। জাতীয় পর্যায়ে তাদের ভূমিকা প্রায়শই উপেক্ষিত থেকে যায়। কিন্তু একটি দেশের সামগ্রিক চিত্র তখনই সম্পূর্ণ হয়, যখন তার প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের কথা শোনা যায়। আর এই কাজটি অত্যন্ত নিষ্ঠা ও সাহসিকতার সাথে করে চলেছেন মফস্বল সম্পাদকরা।
তাই, মফস্বল সম্পাদকদের প্রতি আমাদের আরও সংবেদনশীল হওয়া উচিত। তাদের পাশে দাঁড়ানো এবং তাদের কাজকে উৎসাহিত করা আমাদের সকলের দায়িত্ব। তাদের সহায়তা করলে কেবল সাংবাদিকতাই সমৃদ্ধ হবে না, বরং প্রতিটি মফস্বল এলাকার সাধারণ মানুষের কণ্ঠস্বর আরও শক্তিশালী হবে। মফস্বল সম্পাদকরা শুধু পেশাদার নন, তারা হলেন স্থানীয় সমাজের মেরুদণ্ড—যাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে টিকে আছে স্থানীয় সাংবাদিকতার ঐতিহ্য এবং বিকাশ হচ্ছে সত্যিকারের গণমাধ্যমের।
মো. সোহেল মিয়া, মফস্বল সম্পাদক, জাতীয় দৈনিক নববাণী 
























